ওয়াল নিউজ ডেস্ক
মাহতাব উদ্দিন বাংলাদেশে একজন বড় প্রবাসী বিনিয়োগকারী। সিলেট উইমেন্স হাসপাতালের অন্যতম পরিচালক। দেশ-বিদেশে অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে তার। কোনোদিন রাজনীতির ধারে কাছেও যাননি। তিন দশক ধরে বেশিরভাগ সময় কাটে সৌদি আরবেই। বন্যা খরা শীত বা যে কোনো দুর্যোগে এসে মানুষের পাশে দাঁড়ান। গত তিনমাস সৌদি আরবে থাকলেও মাহতাব উদ্দিন এখন গোলাপগঞ্জে নাজমুল হত্যা মামলার আসামি। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে গুলিতে নিহত নাজমুলের স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় তিনি ১৪৩ নম্বর আসামি।
শুধূু মাহতাব উদ্দিন নন, এরকম বহু সাধারণ মানুষের নাম রাজনৈতিক মামলায় আসামির তালিকায় উঠেছে। সিলেট নগরের জেলরোড ও কোর্ট পয়েন্টে সংঘটিত মারামারির মামলায় এক মিডিয়াকর্মীর পরিবারের পিতা-পুত্র, ভাই ভাতিজাও আসামি হয়েছেন। কয়েকটি মামলা পর্যালোচনায় এমন ভয়ংকর তথ্য মিলেছে।
সিলেটে গত এক মাসে বিভিন্ন থানা ও আদালতে দায়ের করা মামলার অনেকগুলোতেই রাজনীতিবিদের পাশাপাশি নিরপরাধ ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে অনেকেই মুখ খুলছেন না। তবে দেশের সুশীল সমাজ এ নিযে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন এতে করে প্রকৃত ঘটনা আড়াল হচ্ছে। প্রকৃত দোষীরা পার পাবে আর মামলাগুলোও ভবিষ্যতে তদন্তে এবং বিচারকাজে ন্যায় বিচারপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেট জেলার বিভিন্ন থানা এবং আদালতে গত একমাসে অর্ধশতাধিক মামলা হয়েছে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের সময়কার নানা ঘটনায়। অধিকাংশ ঘটনার অভিযোগ, ঘটনার সময়, সত্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না উঠলেও মামলার আসামি তালিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব মামলায় আওয়াম লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী, পুলিশ, ব্যবসায়ী. আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সাধারণ নাগরিকদের আসামি করায় খোদ বিএনপি -জামায়াতেই ক্ষোভ বাড়ছে। কেউ কেউ বলছেন দলের অনুমতি ছাড়াই এসব হচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলছেন দীর্ঘদিনের শত্রুতা রয়েছে এমন সব মানুষরাও রাজনৈতিক এসব মামলায় আসামি হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে বাদীই জানেন না কেনো কী কারণে আসামি করেছেন এসব সাধারণ নাগরিকদের। আর এতে করে এসব মামলার ভবিষ্যত নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বাধিক সমালোচনা হচ্ছে গোলাপগঞ্জে দায়েরকৃত সানি ও নাজমুল হত্যা মামলা নিয়ে। পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, অভিযোগ প্রত্যাহার, সংবাদ সম্মেলন থেকে শুরু করে নানা ঘটনা পর্যন্ত গড়িয়েছে বিষয়গুলো। আর সিলেট নগরের মামলাগুলোতে পারিবারিক ও মহল্লাগত বিরোধের জের ধরে অনেকেই আসামি হয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
সিলেট মেট্রোাপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ১ম আদালতের কোতোয়ালি থানার সিআর মামলা নং ২৩/২৪ এর বাদী বাবলু মিয়া। মামলার ঠিকানামতে তিনি নগরের বালুচর আরামবাগ এলাকার ২ নং সড়কের ১৩ নম্বর বাসার সিরাজ মিয়ার ছেলে। তিনি মামলা করেছেন সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক এমপি হাবিবসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে। এ মামলায় ৯ নম্বর আসামি করা হয়েছে আব্দুর রহমান হীরা নামের এক সাংবাদিকসহ তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের। তাঁর সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে সেখানে বলা হয়েছে তিনি ১০ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। একইভাবে তাকেসহ তার পুত্রসহ পরিবারের ভাই, ভাতিজাসহ আরো পাঁচজনের বিরুদ্ধে সিলেটের মেট্র্ােপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ১ম আদালতের ও দ্রুত বিচার আদালতে আরেকটি অভিযোগ জমা পড়েছে। যার নম্বর ৯৭১২০২৪ (কাগজে প্রাপ্ত)। মামলার বাদী মামুনুর রশীদ, যার বাড়ি কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ থানার বড়কাঞ্চি মায়ারবাড়ি গ্রামে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে আব্দুর রহমান হীরা ছাড়াও তার কলেজপড়ুয়া পুত্র পাপ্পুসহ দুজনকে। ১ম মামলার বাদির বাসা বালুচরে এবং আসামিদের বাসা ঘাসিটুলায়। ঘটনাস্থল দেখানো হয়েছে জেলরোডে। ঘটনার তারিখ ৪ আগস্ট, সময় সাড়ে বারোটা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে মামলার ৪১ জন আসামি সহ ৩০০ জন লোক সেখানে বাদী ও তার দলের কর্মীদের উপর হামলা চালিয়েছে। আহত হয়েছেন তারা। ১৬ ল্ইানের মুল অভিযোগ সম্বলিত এ মামলার পাতার সংখ্যা দাড়িয়েছে ৫ টি, আর নথিতে যুক্ত আছে আরও ৪ পৃষ্ঠা। এতে আসামির সংখ্যা দেয়া হয়েছে ৭৬ জন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আব্দুর রহমান হীরা জৈন্তাবার্তাকে বলেন, তিনি রাজনীতির ধারেকাছেও নেই। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে সব সময়ই পেশাগত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তিনি বলেন পারিবারিক ও মহল্লাগত বিরোধের কারণেই স্থানীয় একটি মহলের ষড়যন্ত্রে পরিবারের পাঁচজন সদস্যকে মামলায় জড়ানো হয়েছে। তিনি এসব মিথ্যা মামলা থেকে অব্যাহতি চান।
অপরদিকে একইভাবে গোলাপগঞ্জের একটি হত্যা মামলার নথিতে দেখা যায় সেখানে ৪ আগস্ট ছাত্র জনতার গণমিছিলে নিহত নাজমুল ইসলামের স্ত্রীর দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ১১৮ জন আসামির নামে একটি মামলা রুজু করেন। এ মামলায় আসামি করা করা হয়েছে সিলেট উইমেন্স হাসপাতালের পরিচালক, সৌদি প্রবাসী শিল্প উদ্যোক্তা মাহতাব উদ্দিনকেও।
এ বিষয়ে শিল্প উদ্যোক্তা মাহতাব উদ্দিন জৈন্তাবার্তার এ প্রতিবেদককে টেলিফোনে জানান, তিনি বছরের বেশিরভাগ সময়েই সৌদিআরবে থাকেন। গত চারমাস ধরে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। মামলায় আসামি হওয়ার খবর শুনে তিনি অবাক হয়েছেন।
শুধু সাংবাদিক আব্দুর রহমান হীরা কিংবা ব্যবসায়ী মাহতাব উদ্দিন নন, এরকম মামলায় আরো বহু সাধারণ মানুষ আসামি হয়েছেন। যাদের পরিবারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী রবিবার দৈনিক জৈন্তাবার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দলের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সাধারণ মানুষকে যেন জড়ানো না হয়। এরপরও যদি কেউ জড়ায় তাহলে নিরীহ মানুষদের জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে সর্বাত্মক আইনি সহায়তা দেওয়া হবে, যাতে তারা এসব মামলা থেকে রেহাই পান। কোনোভাবেই যেন নিরীহ কেউ হয়রানির শিকার না হন। এরকম অন্যায় কাজের সঙ্গে বিএনপির কেউ জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।