ওয়াল নিউজ ডেস্ক
টান টান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে। আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি হতে যাচ্ছে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে ৪৭তম প্রেসিডেন্ট বেছে নেবে মার্কিনীরা। নির্বাচনের মূল পর্বের আগেই এবার আগাম ভোটের রেকর্ড হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত দেশটির প্রায় তিন কোটি ২৫ লাখ ভোটার তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেছেন।
রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুগামীদের দাবি, আগাম ভোটের ফলে সুবিধা পাবে তারাই। ৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন হলেও অন্তত ৪০ প্রদেশে গত সপ্তাহ থেকে আগাম ভোটপর্ব শুরু হয়েছে। এতে প্রথম দিনই ভোট দেয় প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ মার্কিনী। খবর আলজাজিরা, বিবিসি ও সিএনএন অনলাইনের।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ প্রদেশের প্রতিটিতেই নিজস্ব ভোটিং পদ্ধতি রয়েছে। পোস্টের মাধ্যমে ব্যালট সংগ্রহ এবং পোলিং স্টেশনে সশরীরে গিয়ে আগাম নির্বাচনের দিন ভোটদানের ব্যবস্থা রয়েছে। কোনো কোনো প্রদেশে একসঙ্গে তিনটি পদ্ধতিই প্রচলিত। অতীতে বিভিন্ন নির্বাচনে দেখা গেছে আগাম ভোটের ক্ষেত্রে রিপাবলিকান প্রার্থীরাই সাধারণত এগিয়ে থাকেন। এবারও ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসের তুলনায় ট্রাম্পের পাল্লা ভারি বলে বিভিন্ন জনমত সমীক্ষায় ইঙ্গিত মিলেছে।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন সংক্রান্ত পরিসংখ্যান রিপোর্ট বলছে, ২০২০ সালের নির্বাচনে প্রতি সাতজন ভোটারের একজন আগাম ভোট দিয়েছিলেন। এবার সেই হার আরও বেড়েছে। গত দুমাসে প্রকাশিত অধিকাংশ জনমত সমীক্ষায় রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ট্রাম্প কমলা হ্যারিসের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু শেষবেলায় বিভিন্ন সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, দু’জনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ চাকরিজীবী ভোটারদের নজরে রেখেই ট্রাম্প অভিবাসন নিয়ে সুর চড়িয়েছেন।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নিয়ম বলছে, যে প্রদেশে যিনি পপুলার ভোটে (সাধারণ নাগরিকদের ভোট) জিতবেন, তিনিই সেই প্রদেশের সব কটি আসন (ইলেক্টোরাল ভোট) পাবেন। ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল ভোটের মধ্যে ২৭০টি ভোট পেতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘দোদুল্যমান’ সাতটি প্রদেশ (সুইং স্টেট বলে যেগুলো পরিচিত) জয়-পরাজয় নির্ধারণে বড় ভূমিকা নিতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে জয় নিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে লড়ছেন ট্রাম্প। তরুণ ভোটারদের, বিশেষ করে যারা প্রথমবার ভোট দেবেন, তাদের সমর্থন আদায়ে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। এই প্রজন্ম মূলত জেনারেশন জেড নামে পরিচিত।
এবারের নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণ করবে দোদুল্যমান সাতটি অঙ্গরাজ্য। এর একটি জর্জিয়া। সেখানকার নতুন ভোটাররাও ট্রাম্পকে ভোট দিতে চাইছেন। ক্যামরন নামে এক ভোটার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এখন যা হচ্ছে, তা অনেক তরুণই পছন্দ করে না। তার ধারণা, ডেমোক্র্যাটরা এলজিবিটিকিউ এজেন্ডা এবং ট্রান্সজেন্ডার এজেন্ডার পেছনে খুব বেশি সময় ব্যয় করছে। অথচ মানুষের নিত্যদিনের সমস্যা সমাধানে পর্যাপ্ত সময় দিচ্ছেন না। এই হাইস্কুলপড়ুয়া আরও বলেন, ‘তরুণসমাজ এখন আর এসব চান না। তারা একজন শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর নেতা চান, যার মেরুদ- আছে। তারা শ্রদ্ধা ও সম্মান করার মতো একজনকে চান।
সোমবার ট্রাম্পের নির্বাচনী সমাবেশে অংশ নেন ১৮ বছর বয়সী সিজার ভিয়েরাও। এই তরুণ বলেছেন, আগাম ভোট দেওয়ার ব্যবস্থাপত্রের সুবিধা নিয়ে তিনি যত দ্রুত সম্ভব ট্রাম্পকে ভোট দিতে প্রস্তুত। একাধিক অঙ্গরাজ্যে এ ব্যবস্থা চালু আছে। সিজারের কাঁধে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পতাকা ঝুলছিল। তিনি বলছিলেন, ‘তরুণ আমেরিকানদের জন্য ট্রাম্প অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক ভালো। এই মুহূর্তে আমাদের অর্থনীতির জন্য তিনিই সেরা। এই ভোটার ঘরবাড়ি সংস্কারের কাজ করেন। কিন্তু কখনো নিজের একটি বাড়ি বানানোর সামর্থ্য হবে কি না, তা নিয়ে তিনি শঙ্কিত।
নির্বাচিত হলে ৭৮ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ট্রাম্প। এর মধ্যদিয়ে সবচেয়ে প্রবীণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন তিনি। তবে ট্রাম্পের বয়স নিয়ে উদ্বিগ্ন নয় সিজার। সিজার বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা (বয়স) কোনো ব্যাপার নয়, তিনি মানসিকভাবে কেমন করছেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯ বছর বয়সী কম্পিউটার প্রকৌশলী ট্রেনটন ডাইকস। তিনিও এবার ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। তিনি বলেন, ‘ কোনো প্রার্থীই নিখুঁত নন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ থাকলেও তার সমর্থনে অটল ট্রেনটন ডাইকস।
ট্রাম্প তার নির্বাচনী সমাবেশে বারবারই অভিবাসীদের পশু এবং অপরাধী বলেছেন। ট্রেনটন বলেন, ‘আমরা তাকে ইতোমধ্যে চার বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেয়েছি। আমার মনে হয় না, এ সময় তিনি নীতিগত দিক থেকে বর্ণবাদী কোনো আচরণ বা কাজ করেছেন। এই শিক্ষার্থী প্রথমে স্বতন্ত্র প্রার্থী রবার্ট কেনেডি জুনিয়রের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। পরে তিনি রবার্ট ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানানোর ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।
ট্রেনটন বলেন, ‘আমি চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে কাউকে ভোট দিই না।’ ট্রাম্প ভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে নিজের দিকে টানছেন।
নির্বাচনের একেবারে শেষ মুহূর্তে এসেও ট্রাম্প প্রচার চালাতে গিয়ে অশালীন কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন। তিনি একদিকে যেমন কমলাকে ‘কম বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব’ এবং অপরদিকে অভিবাসীদের ‘খারাপ ও রক্ত পিপাসু’ বলে অভিহিত করছেন। এতে তার নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। শেষ সময়ের প্রচারে ট্রাম্প কিছুটা বেসামাল ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করে যাচ্ছেন।
রবিবার নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ট্রাম্প ‘বর্ণবাদ ও অবৈধ অভিবাসন’ বিরোধী অশালীন ভাষায় মন্তব্য করে সমাবেশ শুরু করেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের লাগামহীন বক্তব্য নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তার ভোট চলে যাবে কমলার ঝুলিতে। এর ফলে ট্রাম্পের পরাজয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যেতে পারে।
ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের সমাবেশে ট্রাম্প অভৈধ অভিবাসন বন্ধ এবং অভিবাসীদের আমেরিকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি অভিবাসীদের ‘খারাপ এবং রক্তপিপাসু’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি আমেরিকার ইতিহাসে নির্বাসন কর্মসূচি চালু করব। রিপাবলিকান প্রার্থী বলেছেন, ‘প্রতিটি শহর থেকে অবৈধ অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেব। এ ছাড়া সমাবেশে তিনি কমলাকে ‘কম বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যাক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে সাবেক আইনজীবী গিউলিয়ানিও দাবি করেছেন ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে কমলা ‘সন্ত্রাসীদের পক্ষে’ অবস্থান নিয়েছেন। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে এবারের নির্বাচন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, বেশ কয়েকটি ভাসমান রাজ্যের ভোটের ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনে জয়-পরাজয়।
কে কোন রাজ্যে এগিয়ে ॥ আর ছয় দিন পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এবারের নির্বাচনও ২০২০ সালের পুনরাবৃত্তি হতে পারত। কিন্তু গত জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দেওয়ার পর থেকেই নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি পাল্টে যেতে থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র কি প্রথমবারের মতো নারী প্রেসিডেন্ট পেতে যাচ্ছ? নাকি দ্বিতীয় মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন? নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির প্রধান দুই দলের প্রার্থী ও প্রচার শিবিরের দৌড়ঝাঁপ ততই বাড়ছে। হোয়াইট হাউজে যাওয়ার দৌড়ে কোন প্রার্থী এগিয়ে রয়েছে সে বিষয়ে নজরে রয়েছে মার্কিন ভোটারসহ পুরো বিশ্বের।
জাতীয়ভাবে এগিয়ে কে ॥ জুলাইয়ের শেষ দিকে কমলা হ্যারিসকে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। তখন থেকেই নির্বাচনি প্রচার শুরু করেন তিনি। বিপরীতে শুরু থেকেই রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালাচ্ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সম্প্রতি এবিসি নিউজের এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৮ শতাংশ সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আছেন হ্যারিস। বিপরীতে মাত্র এক শতাংশ কম সমর্থন রয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের।
যদিও এ ধরনের জরিপগুলো পুরো দেশে একজন প্রার্থী কতটা জনপ্রিয় তার একটি আভাস দেয় বটে; তবে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষেত্রে তা যথাযথ নয়। এবারের নির্বাচনে সাতটি রাজ্যকে স্যুইং স্টেট বা দোদুল্যমান রাজ্য হিসেবে ধরা হচ্ছে। এগুলোতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
জরিপের গড় কীভাবে তৈরি করা হয় ॥ বিভিন্ন জরিপ সংস্থার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে জাতীয়ভাবে এই নির্বাচনের গড় তৈরি করা হয়। টেক্সট মেসেজ, টেলিফোন কল বিভিন্ন মাধ্যমে এক ধরনের জরিপ তথ্য প্রকাশ করা হয়। বিবিসির ব্যবহৃত গড়গুলো এবিসি নিউজের অংশ। এবিসি শুধু সেই জরিপগুলো অন্তর্ভুক্ত করে যেগুলো নির্দিষ্ট মান পূরণ করে; যেমন: কতজন ভোটার জরিপে অংশ নিয়েছে, জরিপটি কখন এবং কীভাবে করা হয়েছে ইত্যাদি।
জরিপগুলোর ওপর আস্থা রাখা যায় ॥ এই মুহূর্তের জরিপে দেখা যাচ্ছে, কামালা হ্যারিস এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় সব সুইং স্টেটে খুব কাছাকাছি অবস্থানে আছেন। যখন ব্যবধান এতটা কাছাকাছি হয়, তখন বিজয়ী অনুমান করা কঠিন হয়ে যায়। ২০১৬ এবং ২০২০ উভয় ক্ষেত্রেই জরিপগুলো ট্রাম্পের জনসমর্থনকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি। এবার এই সমস্যা সমাধানে জরিপ সংস্থাগুলো বিভিন্ন পরিবর্তন আনছে, পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে এসব সংশোধনীও ভোটের সঠিক চিত্র পুরোপুরি তুলে ধরতে পারে না।