ওয়াল নিউজ ডেস্ক:
বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পানি কমে আসায় সুরমা, কুশিয়ারা মনুসহ হবিগঞ্জের সবকটি নদ-নদীতে কমতে শুরু করেছে পানি। প্রধান প্রধান নদীগুলোর অনেক পয়েন্টেই এখন বিপৎসীমার নিচ দিয়ে পানি অতিবাহিত হচ্ছে। নদ-নদীর পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি দুর্গতদের। তবুও বন্যায় আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। প্রতিনিয়ত তাদেরকে দেয়া হচ্ছে খাদ্য সামগ্রীসহ ত্রাণ সহায়তা।
মৌলভীবাজারের প্রধান চারটি নদ-নদীর মধ্যে তিনটির পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। এর মধ্যে মনু নদের পানি রেলওয়ে ব্রিজের কাছে বিপদসীমার নিচে নেমে এসেছে। তবে মৌলভীবাজার শহরের কাছে মনু নদের পানি কিছুটা কমলেও বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। অপরদিকে ধলাই নদের পানি বিপদসীমার অনেকটা নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারতে ত্রিপুরায় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবং উজানে ঢলের পানি কমে আসায় জেলার নদ-নদীগুলোর পানি কমতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
এদিকে বন্যাদুর্গত মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন গবাদিপশু নিয়ে। বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে আছে। অনেক বাড়িঘর পানির নিচে রয়েছে। এতে অনেকে গবাদিপশু নিয়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। আবার অনেকেই উঁচু জায়গায় গবাদিপশু বেঁধে রেখেছে। কিন্তু এই প্রাণীগুলোর খাবারের খুব সংকট। কেউ কেউ গবাদিপশুকে ধানের গুঁড়া খাওয়াচ্ছেন।
গবাদিপশুর মালিকেরা বলেন, ‘আমাদের অনেকেই সাহায্য করেছেন বা করবেন। কিন্তু চার দিন ধরে একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে গবাদিপশুগুলো। অনেক পশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। চরম গোখাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সবকিছুই বন্যার পানির নিচে। খড় ছাড়া আর কিছুই খাবার দেওয়া যাচ্ছে না। পানি কিছুটা কমেছে, তবে ঘাস ও গোখাদ্য পচে গেছে।’
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলমান বন্যায় এই খাতে প্রায় ৮৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় ১১ হাজার ২১৮টি গরু, ২ হাজার ৯২১টি মহিষ, ৮ হাজার ৮৮টি ছাগল, ৫০০ ভেড়া, ৩৬ হাজার ৭৬৪টি মুরগি ও ২৪ হাজার ৩৪৫টি হাঁস বন্যাকবলিত হয়েছে। তবে এই সংখ্যা লক্ষাধিক বলে বন্যাকবলিত মানুষেরা জানান।
মৌলভীবাজার জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম খান বলেন, ‘মৌলভীবাজার বন্যা পরিস্থিতিতে মানুষের পাশাপাশি যাদের ঘরে গবাদিপশু আছে, তারা স্বাভাবিকভাবে একটু বেশি সংকটে পড়েছে। আমরা জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছি গোখাদ্য বিতরণ করার জন্য। সাতটি উপজেলায় আমাদের ১৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।’
হবিগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস থেকে দেয়া তথ্যে দেখা যায়, জেলায় এ পর্যন্ত ৬টি উপজেলার মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। বন্যায় আক্রান্ত হওয়া উপজেলাগুলো হল, চুনারুঘাট উপজেলা, মাধবপুর উপজেলা, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা, হবিগঞ্জ সদর, নবীগঞ্জ ও বাহুবল উপজেলা। এসব উপজেলায় মোট ২৯টি ইউনিয়নের ১৬ হাজার ৪৪০টি পরিবার বন্যার পানিতে আক্রান্ত হয়েছে।
আর এতে করে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে ৬৫ হাজার ৫৬০ জন মানুষ। গতকাল শনিবার দুপুরে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সুমি রানি বল। তিনি জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের জন্য এখন পর্যন্ত মোট ১২৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে চালু রয়েছে ৭টি কেন্দ্র। আশ্রয় কেন্দ্রেগুলোর মধ্যে ৪৫২ জন পুরুষ, ৫২৫ জন মহিলা, ১১১ জন শিশু ও ৫ জন প্রতিবন্ধি আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে অনেকে গবাদি পশুও সাথে নিয়ে এসেছেন।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যমতে, জেলার সাত উপজেলায় বন্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক লাখ ৯৫ হাজার ২৪৫ জন। ৪৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন সাত হাজার ১৪৫ জন। পৌরসভা ও ইউনিয়ন মিলে ৪৭টি এলাকায় বন্যায় প্লাবিত হয়েছে ২১২টি গ্রাম। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৮৫ মেট্রিক টন চাল ও সাত উপজেলায় ৪৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিতরণ হয়েছে। মেডিক্যাল টিম রয়েছে ৬০টি। মজুতকৃত টাকা আছে ২৪ লাখ ৫০ হাজার। চাল আছে এক হাজার ৩৪ মেট্রিক টন।
পাউবো মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল বলেন, ‘নদ-নদীর পানি কমছে। এতে নদীতে পানির চাপ কমছে। রাজনগরে ভাঙন দিয়ে পানি বের হলেও পানির গতি আগের মতো নেই। গতি কমে আসছে। উজানে বৃষ্টিপাত নেই। আমাদের কাছে যেটুকু তথ্য আসছে, তাতে ভারতের কৈলাশহরেও পানি কমছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পরিস্থিতির ভালোই উন্নতি হবে আশা করছি।’
এদিকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত চুনারুঘাট উপজেলায় খোয়াই নদীর বাল্লা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার, শায়েস্তাগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩১৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার মাছুলিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৭০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও কুশিয়ারা নদীর শেরপুর পয়েন্টে ৯ সেন্টিমিটার, বানিয়াচং মার্কুলি পয়েন্টে ৪ সেন্টিমিটার এবং আজমিরীগঞ্জের কালনী নদীতে ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
অপরদিকে বন্যা দুর্গত বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা যায় পানি কমতে শুরু করলেও দূর্ভোগ কমেনি দুর্গতের। এখনও বহু ঘরবাড়ি রয়েছে পানির নিচে। গরু বাছুর ছাগলসহ গৃহপালিত পশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন অনেকেই। আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেয়া উমেরা খাতুন নামে এক নারী জানান, ঘর বাড়ি পানির নিচে থাকায় আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছি। তবে আমাদের মালামাল পানিতে নষ্ট হয়ে অনেক ক্ষতি হয়েছে। হাছেনা খাতুন নামে আরেক নারী জানান, পানি ধীরে ধীরে কমছে। তবে এখনও আমরা বাড়ি যেতে পারছি না। আমাদের দুর্ভোগও কমছে না।