
মনোয়ার পারভেজ
চব্বিশের ছাত্র আন্দোলনের শুরুতে বেসরকারি অর্থাৎ ‘প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়’ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুলেছিল। এবং জাতীয় ইস্যুতে ইতিহাসের পাঠে প্রাইভেট ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নেই বলে কথা উঠেছে তখন। হ্যাঁ, এই দাবি অনেকাংশেই সত্যি ছিল। তবে বেসরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তেমন অংশগ্রহণ না থাকারও কিছু কারণ ও প্রেক্ষাপট দাঁড়িয়ে ছিল।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নেই যদি বলি, তখন দেশে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হলো ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি – আইইউবিএটি। ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এবং ১৯৯২ সালে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ করার পর, আইইউবিএটি এই আইনের অধীনে নিবন্ধিত হয়। এখন যেহেতু ১৯৯১ সালের আগেই মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও জাতীয় অনেক ইস্যু তৈরি হয়েছিল। সুতরাং ইতিহাসের পাঠে সেখানে তাদের অংশগ্রহণ থাকার কোনো সুযোগ ছিল না। এরপর আসি দ্বিতীয় প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য থাকে বিদেশমুখী। সুতরাং দেশের জাতীয় ইস্যুতে তাদের ভাবার সময় নেই। এমনকি পড়াশোনার জন্য সরকারের কাছ থেকে যে-সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার থাকার কথা, সেটাও তাদের ভাবনায় নেই। কারণ, তারা মনে করে এখানে নিজের বাবার পয়সায় পড়তে আসছে বিদায় নিজেদের অর্থায়নেই সব জিনিস পেয়ে যায়। কিন্তু সেখানেও যে সরকারের কিছু অর্থায়ন ও প্রতিশ্রুতি থাকে, থাকতে হয় সেসব বিষয়ে দেখবেন তারা কিছুই জানে না। আরও একটি বিষয় হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সরাসরি ছাত্র রাজনীতির কোনো সুযোগ নেই। তাই দেশের রাজনীতি, দেশ ও রাষ্ট্র নিয়ে খোঁজখবরের প্রয়োজনও তাদের নেই। তবে যেখানে সরাসরি ছাত্র রাজনীতি থাকে না সেখানে সরকারের পক্ষের লোকদের একটা অঘোষিত বাড়তি ক্ষমতায়ন থাকে। সুতরাং সেখান থেকে বিরোধী মত পোষণ করা সম্ভব হয় না। যেহেতু তাদের কোনো ছাত্র সংগঠন থাকে না, তারা সহজেই একত্রিত হয়ে বিরোধী মত উপস্থাপন করতে পারে না। করলেও তাদেরকে নানা বিধি-নিষেধ এর মধ্যে পড়তে হয়। আর সরকারি দলের শিক্ষার্থীরা স্থানীয় ক্ষমতাশীল নেতাদের দাপটে চলে বেড়ায়।
এরপর যদি আসি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাপে- বাংলাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রাও শুরু হয় ১৯৯২ সাল থেকে। সেখানেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ৯২ এর আগের ইতিহাসের পাঠে তাদের থাকার সুযোগ নেই। তবে এরপরেও ছোট-বড় নানা ইস্যুতে তাদের তেমন অংশগ্রহণ না থাকাটা কিছুটা হতাশার বটে। তবে সেখানেও আছে নানা প্রেক্ষাপট। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যে-সব কলেজ এগুলো শহর, মফস্বল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি থাকলেও শিক্ষার্থীরা এতোটা ক্যাম্পাসমূখী নয়। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই আছে যারা ক্লাসে নিয়মিত নয় বা বছরে ক্লাসও করে না। বাড়িতেই থাকে। পরীক্ষায় সময় এসে পরীক্ষা দিয়ে যায়। আবার অনেকে আছে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় সাময়িক একটা চাকরি জুটিয়ে নেয়। বাংলাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এক হতাশা ও অনিশ্চয়তার জায়গা। তাদেরকে পড়াশোনা ও আনুষঙ্গিক বিষয়ের চেয়ে ক্যারিয়ার নিয়েই বেশি চিন্তিত থাকতে হয়। তাই তাদের এসব দেখার সময় নেই। তবে একথা বলতে হয়, এর আগেও বিভিন্ন ইস্যুতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট-বড় ইতিহাস রয়েছে। মফস্বল থেকে উঠে আসা নেতাদের অধিকাংশেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি ও বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে আন্দোলন-সংগ্রাম করেই উঠে এসেছে। তাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যে দাবি/অভিযোগ তা পুরোপুরি সত্য নয়। কেননা এজন্যই তাদেরকে একেবারেই ইতিহাসের পাঠ থেকে ফেলে দেওয়া যাবে না।
তবে এবারের চব্বিশের ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ব্যাপক ভূমিকা ছিল বেসরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। বিশেষ ভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলব। পুলিশ ও ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের বর্বর হামলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একসময় পিছু হটতে বাধ্য হতে হয়। তখন বেসরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসে স্ফুলিঙ্গের মতো। এবং শেষ পর্যন্ত তারাই ছিল। এই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র মারা না গেলেও খোদ ঢাকাস্থ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীকে জীবন দিতে হয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছেন – সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইরফার ভুঁইয়া, নর্দান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ওবায়দুল্লাহ এবং আসিফ হাসান, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শাকিল পারভেজ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শাহ নেওয়াজ ফাহাদ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আসিফ ইকবাল সহ আরও অনেকেই আছেন এই তালিকায়। এবং মফস্বল থেকে শুরু করে গ্রামে-গঞ্জেও বেসরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে সোচ্চার হতে শুরু করে। তারপর সাধারণ জনগণও ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়াতে থাকে। এভাবেই জন্ম হয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। সুতরাং এই আন্দোলনের পর আর বেসরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
কিন্তু চব্বিশের ছাত্র আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের পরবর্তীকালে বেসরকারি এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসলে কী পেল? এটাও এখন একটা বড় প্রশ্ন। সর্বত্রই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একচেটিয়া দাপট! কথিত বড় বড় সমন্বয়কদের নামের পাশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যাগ। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নবগঠিত দল এনসিপিতেও দেখা গেল সামনের সারিতে সবাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই উঠে আসা। এবং পাঁচ আগস্ট পরবর্তী বিভিন্ন ইস্যুতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইস্যুকে ছাপা দেওয়ার ‘বন্দোবস্ত’ চালু হয়েছে। এই যে বৈষম্য এটাকে কোন নিক্তি দিয়ে মাপবেন? অথচ এই আন্দোলনের প্লাটফর্মটি ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে। তবে এটা ঠিক, কে জায়গা দিলো বা নাইবা দিলো। ইতিহাসে তারা গৌরবের সাথে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছে। তারা প্রমাণ রেখেছে দেশের স্বার্থে তারাও পিছিয়ে নেই।