
তাওহীদ রহমান
এরিস্টটল বলে গেছেন, ‘যে সমাজে অপরাধীর শাস্তি হয় না, সে সমাজে ন্যায়বিচারের মৃত্যু ঘটে।’
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতায় পাথর ছুঁড়ে/পিটিয়ে মানুষ হত্যা, চাঁদাবাজি বা যেকোন নৃশংসতার মতো ঘটনা রাজনৈতিক সহিংসতা, দূর্বল আইনের শাসন ও দলীয় সন্ত্রাসের সংস্কৃতির প্রতীক।
টেলিভিশন বা পত্র-পত্রিকার চেয়েও এখন অধিক শক্তিশালী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম৷ অহরহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া নারকীয় সব ঘটনার খবর আসে আমাদের সামনে। আমরা তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদে ফেটে পড়ি। মিছিল, সমাবেশ করে দোষীদের বিচারের দাবি জানাই। কখনো কখনো খবর পাই সংশ্লিষ্ট দল অভিযুক্তদের বহিষ্কার করেছে আর প্রশাসনও এ্যাকশনে গিয়ে আটক করে দোষীদের৷ এরপর……..? অন্য কোনো ঘটনার ভিড়ে চাপা পড়ে যায় মানুষের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ আর ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তি।
এখন কথা হল, এ ধরনের অপরাধ কেন ঘটে? নমুনা দিই। এদেশে কিছু দল স্থানীয় পর্যায়ে সশস্ত্র গ্রুপ (মাস্তান/গুন্ডা) তৈরি করে, যারা দলের নামে চাঁদা আদায়, প্রতিপক্ষ দমনে সহিংস আচরণ করে। কখনো কখনো নেতাদের সরাসরি মদদে এসব গ্রুপ আইনের ঊর্ধ্বে থেকে নিষ্পাপ নাগরিককে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না৷
ফলে রাজনৈতিক প্রভাবে পুলিশ প্রায়ই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। এমনকি ভুক্তভোগীরা মামলা করতেও ভয় পায়, কারণ অপরাধীরা শক্তিশালী দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকে। এদেশে কতিপয় দলের নেতারা ব্যবসায়ী, পরিবহন মালিক বা স্থানীয় প্রতিষ্ঠান থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে। প্রতিরোধ করলে হামলা বা হত্যার ঘটনা ঘটে। দুর্ধর্ষ অপরাধীরা দলের উচ্চপদস্থ নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়। নেতারা প্রয়োজনে আইন-প্রয়োগকারী সংস্থাকে বাঁধা দেন।
এদিকে, দলীয় স্বার্থে সহিংসতাকে ‘বীরত্ব’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তরুণদের মাঝে এই সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এভাবে তো একটা রাষ্ট্রযন্ত্র চলতে পারে না৷ এসব অপকর্ম কীভাবে রোধ করা সম্ভব? উত্তরে বলা হয়, আইনের কঠোর প্রয়োগ। তবে বাস্তবতা যাহোক, রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে অপরাধীদের দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরী৷ প্রয়োজনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে রাজনৈতিক সহিংসতার মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়।
পাশাপাশি দলীয় নেতাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের দল থেকে কেবল বহিষ্কার করলেই হবে না, আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে হবে৷
এদেশে এমন দল রাজনৈতিক অঙ্গনে মেলা ভার, যার দলীয় ঘোষণাপত্রে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার নীতি যোগ করা আছে।
সর্বোপরি, সুশীল সমাজ, মিডিয়া ও সাধারণ মানুষকে একত্রিত করে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন গড়ে তোলা দরকার। অধিক সংখ্যক
ভুক্তভোগীদের কণ্ঠস্বর মিডিয়াতে তুলে ধরার মাধ্যমে এমন পাশবিকতা রোধ করা যায়। মোটকথা, এসব নৃশংসতা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতার চিহ্ন। জড়িত দলগুলোর নেতৃত্ব যদি ইচ্ছা করেন, তাহলে দলীয় সন্ত্রাস বন্ধ করতে কয়েক সপ্তাহই যথেষ্ট—কিন্তু তার জন্য থাকা চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা। একইসাথে জনগণকেও দলীয় আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে রাজনীতি যদি রক্তপাতের মাধ্যম হয়, তাহলে তা সভ্যতার পরাজয়।