মাহফুজ আনাম
'নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে বিতর্কের অবসান জরুরি' শিরোনামে মতামত জানিয়েছেন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম। শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) প্রকাশিত এই মতামত হুবহু নিম্নরূপ:-
প্রত্যাশিতভাবেই প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গের বৈঠক থেকে নিজেদের উত্তরটি পায়নি বিএনপি। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে জুন ২০২৬ এর মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতিতে অটল ছিলেন এবং বিএনপি অনড় ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে। আগের বৈঠকগুলোর সঙ্গে এবারের পার্থক্য হলো—এই প্রথম প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক নিয়ে দলটির মন্তব্য এলো, তারা 'একেবারেই সন্তুষ্ট নয়'।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তার ব্যাখ্যায় বলেছেন, বিএনপিকে 'অসন্তুষ্ট মনে হয়নি' এবং জোর দিয়ে বলেছেন, 'নির্বাচন কোনোভাবেই জুনের পরে যাবে না'। এর ঠিক আগেই তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের 'আমরা যদি কোনো বিচার না করে যাই, কোনো বিচার না করে যদি নির্বাচন দেই, মানুষের কাছে নিজের কাছে জবাব দেবো কীভাবে?'
বিচার ও নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে তার এই বক্তব্য দুটি পরস্পর সাংঘর্ষিক। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, বিচারিক প্রক্রিয়া কি সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সম্পন্ন করা যাবে? সেক্ষেত্রে সেটা কি আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে? আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি তাজুল ইসলাম ইতোমধ্যেই এমন কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন।
জামায়াত আমির বলেছেন, আগামী রমজানের আগেই নির্বাচন হয়ে যাওয়া উচিত। তার মানে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাইছেন তিনি। এটাকে যুক্তিসঙ্গত মধ্যপন্থা বলেই মনে হচ্ছে।
নির্বাচনের পক্ষে যারা রয়েছেন তারা মনে করেন, একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ। এতে জনগণ তাদের নেতা নির্বাচনের অধিকার ফিরে পাবে, স্বচ্ছভাবে আলোচনার মাধ্যমে নীতি অনুমোদন করার মতো কার্যকর সংসদ পাবে এবং জবাবদিহিমূলক সরকার পাবে। 'অন্তর্বর্তী' সরকারব্যবস্থা শেষ হবে এবং আমাদের গণতান্ত্রিক যাত্রা আবার শুরু হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অনিশ্চয়তার যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তা শেষ হয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
বর্তমানে পুরো বিশ্ব আমাদের সঙ্গে যে সম্পর্ক রাখছে তা মূলত ড. ইউনূসের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার কারণে। তার মতো একজন নেতার নেতৃত্বাধীন থাকা যত গর্বেরই হোক না কেন, সেটা জনগণের ভোটে নির্বাচিত কোনো সরকারের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতার বিকল্প হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধকালীন থেকেই গণতন্ত্র ছিল আমাদের গর্বের জায়গা। শেখ হাসিনা আমাদেরকে সেই গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। কাজেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নির্বাচিত সরকার গঠনে অযথা বিলম্ব প্রত্যাশিত না।
যারা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় না তারা মনে করে, এই সময়ের মধ্যে সংস্কারের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে না এবং এখনই নির্বাচন হলে আগের সেই দুর্নীতিপরায়ণ, পরিবারতান্ত্রিক ও একব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থাই ফিরে আসবে। তাদের যুক্তি, আমরা যদি সেই আগের রাজনীতিতেই ফিরে যাই, তাহলে দেড় হাজারের বেশি ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাদের এই যুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনোভাবেই অবহেলা করার মতো নয়। ভবিষ্যতে আমরা যাই করি না কেন, সেখানে এই গণঅভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা—গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সব শ্রেণি ও ব্যক্তির অধিকার, সমতা, বৈষম্যহীনতা, আইনের শাসন, রাজনৈতিক জবাবদিহি প্রভৃতি থাকতে হবে।
কিন্তু, সংস্কার জরুরি হলেও সেটাকে নির্বাচন বিলম্বের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা উচিত না। সংস্কার যেমন জরুরি, তেমনি নির্বাচিত সরকারও জরুরি। দ্য ডেইলি স্টার এবং আমি নিজেও বারবার বলেছি যে সংস্কার ও নির্বাচন দুটোই দরকার এবং ডিসেম্বরের মধ্যেই সেটা সম্ভব।
আমরা এখনো বুঝতে পারছি না, প্রধান উপদেষ্টা কেন নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাব্য সময়সীমার মধ্যে ছয় মাসের পার্থক্য রেখেছেন এবং সেটার বিষয়ে এতটা অনড়। প্রথম দিকে যখন এটা বোঝা যাচ্ছিল না যে সংস্কার কমিশনগুলো কাজ শেষ করতে কতটা সময় নেবে, তখন এই সময়ের পার্থক্য খানিকটা যৌক্তিক ছিল। কিন্তু এখন সবগুলো কমিশনের সুপারিশ হাতে চলে এসেছে এবং এর পরবর্তী ধাপ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপও খুব ভালোভাবেই চলছে। আমরা মনে করি, ড. ইউনূসের কৌশল এখন পর্যন্ত অত্যন্ত কার্যকর হয়েছে। এই গতি বজায় থাকলে ডিসেম্বরের আগে যে আট মাস সময় আছে, তার মধ্যেই উল্লেখযোগ্য সংস্কার সম্পন্ন করা সম্ভব। জামায়াতের প্রস্তাবিত আরও দুই-আড়াই মাস সময় বাড়িয়ে যদি রমজানের আগেই নির্বাচন হয়, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। নির্বাচন কমিশনও ইতোমধ্যে তাদের প্রস্তুতির ঘোষণা দিয়েছে।
জুনে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে আবহাওয়াগত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কেবলমাত্র ১৯৯৬ সালের জুনে একটি নির্বাচন হয়েছিল। সেবার খালেদা জিয়া সরকার পদত্যাগ করায় এবং সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা থাকায় জুনে নির্বাচন হয়। দেশের ইতিহাসের বাকি ১১টি নির্বাচনই হয়েছে শীতকালে। নির্বাচনের জন্য শীতকাল খুবই উপযুক্ত সময়। এই ঋতুর বৃষ্টি-বন্যাহীন মনোরম আবহাওয়া জাতীয় নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশ এনে দেয়।
তারপরও ড. ইউনূস কেন প্রতিকূল আবহাওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও জুনে নির্বাচনের সময়সীমা রাখতে চান তা পরিষ্কার নয়।
ড. ইউনূসকে আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখা উচিত—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন প্রচারণার কারণে নির্বাচন নিয়ে অনেকের মধ্যে অনিশ্চয়তা আরও বেড়ে গেছে। যদিও তার মর্যাদা, খ্যাতি ও জনমানুষের আস্থার কারণেই এমন প্রচারণা করছেন অনেকে। কিন্তু, এর পেছনে এমন কোনো পক্ষও থাকতে পারে, যাদের উদ্দেশ্য খুব একটা ভালো নয়।
এমন ধারণাও আছে, নির্বাচন হয়ে গেলে পদ ও ক্ষমতা হারাতে হবে বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের একটি অংশ এই প্রচারণাকে উসকে দিচ্ছে। এই সন্দেহের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সেই মন্তব্য—'রাস্তা থেকে মানুষ বলে যে, আপনারা আরও পাঁচ বছর থাকেন'। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা আর একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টার একাধিকবার বলা এমন মন্তব্য ভিন্ন জিনিস। যদিও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে এটা তার নয় সাধারণ মানুষের কথা, কিন্তু তাতে সন্দেহ কেবল বাড়িয়েছে।
যত সৎ চিন্তা থেকেই আসুক না কেন, এই ধরনের কোনো উদ্যোগ রাজনৈতিকভাবে বিচক্ষণ কি না, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্ভব কি না, আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য কি না এবং ড. ইউনূসের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির জন্য কল্যাণকর কি না, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবা উচিত।
আমরা সবাই জানি, এই সরকারের বৈধতার ভিত্তি হচ্ছে বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় দেওয়া আপিল বিভাগের একটি 'মতামত' (রায় নয়)। আজীবন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমি মনে করি, এই সরকারের মেয়াদ অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হলে তা ড. ইউনূসকে এমন সব বিতর্কে জড়িয়ে ফেলবে, যা সম্মানজনক হবে না।
বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায় এবং সেটা যে পুরোপুরি স্বার্থহীন নয়, সেটা আমরা বুঝতে পারি। আমরা এটাও বুঝতে পারি যে নির্বাচন নিয়ে এনসিপির অনীহার পেছনে দলীয় স্বার্থ আছে এবং সংগত কারণেই তারা আগে সংস্কার এবং শেখ হাসিনাসহ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যাকারীদের বিচার চায়। নির্বাচন এখন হোক বা পরে, জামায়াত উভয় প্রস্তাবেই রাজি থাকার পেছনেও রয়েছে দলীয় হিসাব-নিকাশ। ফলে, জাতীয় স্বার্থ সেই অগ্রাধিকারটা পাচ্ছে না, যেটা পাওয়া উচিৎ ছিল।
নির্বাচনে তিনটি প্রধান পক্ষ—অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো এবং ভোটার। এখন পর্যন্ত যেসব মতামত আমরা শুনেছি, তা প্রথম ও দ্বিতীয় পক্ষের। কিন্তু, সাধারণ মানুষ কী চায়, সেটা আমরা খুব কমই জানি। এটাই আমাদের সাংবাদিকতার বড় ব্যর্থতা। আমরা দাবি করতে পারি না যে জনমানুষের ভাষ্য আমাদের জানা। তবে, অতীতের রিপোর্টিং ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অনুমান করা যায় যে, সাধারণ মানুষ ২০১৪ সালের পর থেকে হারিয়ে ফেলা ভোটাধিকার ফিরে পেতে চায়। কিন্তু একইসঙ্গে তারা স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান ইত্যাদিও চায়। আর ভোটাধিকার ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন উভয়ই নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব।
কাজেই আমাদের প্রস্তাব, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। তবে, ড. ইউনূসের আরও কিছুটা সময় চাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সর্বোচ্চ ছয় সপ্তাহ বাড়িয়ে এটা হতে পারে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি।
মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
প্রধান সম্পাদক: জাকেরিন চৌধুরী জয়
অফিস: ১০৪/১১ নূরানী বনকলাপাড়া,
সুবিদ বাজার সিলেট।
মোবাইল : ০১৬০১০৩৮৪৮১, Email: thewallnews181@gmail.com