ওয়াল নিউজ ডেস্ক
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য এটি একটি আনন্দঘন মুহূর্ত হওয়া উচিত ছিল। দীর্ঘ ৪০ বছরের কাজ অবশেষে সফল হতে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের তথাকথিত সব ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ ধ্বংস করার লক্ষ্যে তিনি এগিয়ে চলেছেন।
নেতানিয়াহু ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি কৌশল অনুসরণ করেছেন। যা তিনি ১৯৮৬ সালে লেখা তার ‘ঞবৎৎড়ৎরংস: ঐড়ি ঃযব ডবংঃ ঈধহ ডরহ’ বইতে তুলে ধরেছেন। এই বইটির মূল্য বর্তমানে অ্যামাজন ইউকে-তে প্রায় ১৮৭ ডলার।
বইটিতে নেতানিয়াহু সন্ত্রাসবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ঠিক এভাবে, ‘নিরপরাধ মানুষকে হত্যা, আহত করা এবং আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের একটি পরিকল্পিত এবং সুসংগঠিত প্রক্রিয়া’। এটি মূলত সেই কর্মকাণ্ডের বিবরণ, যা ইসরাইল গত এক বছর ধরে অবরুদ্ধ গাজায় এবং বর্তমানে লেবাননে করে যাচ্ছে।
নেতানিয়াহুর সন্ত্রাসবিরোধী তত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো বলপ্রয়োগের ব্যবহার। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের প্রাক্কালে কংগ্রেসে এক শুনানিতে তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘আপনি যদি সাদ্দামকে উৎখাত করেন, আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি, এর ফলে গোটা অঞ্চলে ইতিবাচক পরিবর্তনের ঢেউ উঠবে’।
তবে ক্ষমতার দিক পরিবর্তনই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বয়ে আনবে- এ নিয়ে নেতানিয়াহুর বিশ্বাসগত দিক নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন কংগ্রেসের সদস্য জন টিয়ার্নি। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এটি কী কেবল আপনার অনুমান, না কি আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?’
এমন প্রশ্নেও অবিচল নেতানিয়াহু বলেন, ‘১৯৮৬ সালেও আমি একই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম। আমি একটি বই লিখেছিলাম, যেখানে বলেছিলাম যে সন্ত্রাসী শাসনের সঙ্গে মোকাবিলা করার উপায় হলো তাদের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করা’।
টিয়ার্নি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘ঠিক আফগানিস্তানে যেমনটি আমরা করেছি?’
নেতানিয়াহুর উত্তর ছিল, ‘আমরা আরও ভিন্ন কিছু দেখেছি। প্রথমত, আমরা দেখেছি আফগানিস্তান থেকে সবাই পালিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমরা দেখেছি অনেক আরব দেশ, মুসলিম দেশ আমেরিকার দিকে ঝুঁকছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে’।
আফগানিস্তান প্রায় ২০ বছরের এক দীর্ঘ যুদ্ধের মুখে পড়েছিল, যার শেষটা ছিল আমেরিকার ব্যর্থতা। তবে নেতানিয়াহুর মন্তব্যের কিছু সত্যতাও ছিল। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আক্রমণ চালানোর পর (যেমন ইরাক, লেবানন, লিবিয়া ও সিরিয়া), তখন বাকি প্রো-পশ্চিমা আরব রাষ্ট্রগুলো আরও বেশি করে আমেরিকা ও ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছিল।
নেতানিয়াহুর সেই দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার যে স্বপ্ন, যা তিনি প্রায় চার দশক ধরে লালন করে আসছিলেন, সেই লালিত স্বপ্নই এখন তার নিজের জন্যই বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ইসরাইলের বর্তমান সংকট তার সেই কৌশলেরই প্রতিফলন, যা মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের দীর্ঘমেয়াদি সংকট এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
নেতানিয়াহুর ধারণা ছিল, তিনি ফিলিস্তিনি সমস্যা মোকাবিলা করবেন গাজায় অবরোধ আরোপের মাধ্যমে এবং পশ্চিম তীরে ধীরে ধীরে ইহুদি বসতি স্থাপন করে। কিন্তু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বাধীন আক্রমণের মাধ্যমে সেই কৌশল ভেঙে পড়ে। তখন থেকে তিনি ও তার মিত্ররা পুরোপুরি যুদ্ধের নীতি গ্রহণ করেছেন, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ এবং দখল প্রক্রিয়া দ্রুততর করেছেন।
এছাড়া হিজবুল্লাহর মহাসচিব হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার মাধ্যমে নেতানিয়াহু ইসরাইলের জন্য ‘নরকের দরজা’ খুলে দিয়েছেন। ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার পর ইরানের পক্ষ থেকে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল।
যা গত ১ অক্টোবর রাতে গোটা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। ইরানের ১৮০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র তেলআবিবসহ ইসরাইলের সামরিক ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হানে। ইরানের এই আক্রমণ ইসরাইলের জন্য ছিল একটি মস্ত বড় ধাক্কা।
নেতানিয়াহুর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো যুক্তরাষ্ট্রের অবিরাম সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন। তবে তিনি এখন একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। যেখানে ইসরাইলের একক ক্ষমতা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে একত্রে শাসন করার জন্য যথেষ্ট নয়। তাতে ইসরাইল যত মানুষকেই হত্যা করুক না কেন।
যদিও ইসরাইলের কাছে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে। তবে পুরো মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের মধ্যে পড়লে নেতানিয়াহুর জন্য এটি একটি চূড়ান্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান হয়ে দাঁড়াবে।
অবশেষে নেতানিয়াহুর জন্য এই মুহূর্তটি ট্রাম্পকার্ড হিসেবে থাকলেও, বাস্তবিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ এখন ইসরাইলকে বিরোধী হিসেবেই দেখছে।
প্রধান সম্পাদক: জাকেরিন চৌধুরী জয়
অফিস: ১০৪/১১ নূরানী বনকলাপাড়া,
সুবিদ বাজার সিলেট।
মোবাইল : ০১৬০১০৩৮৪৮১, Email: thewallnews181@gmail.com