মনোয়ার পারভেজ
চা’য়ের শহর সিলেটে বসবাস করার সুবাদে চা-শ্রমিকদের দুঃখ, দুর্দশা এবং দিনাতিপাত খুব কাছ থেকেই দেখার সুযোগ ও অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। মন খারাপ থাকলে আমি প্রায়ই চা বাগানের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে বের হই। বেশিরভাগ সময়ই কেউ না কেউ সাথে থাকেন, কাউকে না পেলে মাঝেমধ্যে একাই চলে যাই। সিলেটের লাক্কাতুরা, মালনিছড়া, দলদলি, তারাপুর চা বাগানের প্রকৃতি প্রতিনিয়ত আমাকে ডাকে। তাই আমিও ছুটে যাই তার দর্শনে। আর এভাবেই দিনে দিনে পরিচয় হয় তাদের জনজীবনের সঙ্গে।
চা বাগানের সাথে এই সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে সেখানকার চা- শ্রমিকদের সঙ্গেও কথা আদান-প্রদানের সম্পর্ক তৈরি হয়ে উঠেছে এখন। আমি তাদের গল্প শুনি, তাদেরকে শুনাতে চাই আমার গল্প। কিন্তু তাদের গল্প শুনে নিজের গল্প শুনানোর ইচ্ছে মরে যায়। তাদের দুঃখে ভরা গল্প ভুলিয়ে দেয় আমার দুঃখ।
সেবার ২০২২ সালের দিকে দেখেছিলাম চা শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বেশ জোরালোভাবে আন্দোলন করেছিলেন। তখন তাদের দৈনিক মজুরি ছিল ১২০ টাকা। আপনারাই বলুন, বর্তমান সময়ে এসে ১২০ টাকা মজুরি কতটা যৌক্তিক? আর এই মজুরি দিয়ে কিভাবে পরিবার এবং সন্তানদের ভরণপোষণ ও শিক্ষার খরচ চালানো সম্ভব? একে একে তাদের আন্দোলন জোরদার হতে শুরু করে। তারা দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবী উত্থাপন করেছিলেন। তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ছিলেন না। দীর্ঘ ১৯ দিনের আন্দোলনের পর শেখ হাসিনা দেশে আসলে তখন ৫০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭০ টাকা দৈনিক মজুরি নির্ধারিত হয়। যদিও বর্তমান বাস্তবিক দিক থেকে এটা কোনো যৌক্তিক মজুরি হতে পারে না।
সাধারণত দুই বছর পরপর চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পায়। ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট তৎকালীন সরকার কারো সাথে আলোচনা না করেই ২০২৪ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ শতাংশ (৮.৫০ টাকা) হারে মজুরি বৃদ্ধির গেজেট প্রকাশ করা হয়। বছরে ৮.৫০ টাকা বৃদ্ধি এটা তাদের সঙ্গে মশকারার মতো! চা- শ্রমিকরা সেই গেজেটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলন এবং তার সঙ্গে ৫০০ টাকা দৈনিক মজুরি দাবি উত্থাপন তোলেন।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর চা-শ্রমিকের আন্দোলনের তোপের মুখে এই গেজেট টিকবে না এমন আভাস পেয়ে গত ৮ সেপ্টেম্বরে ১৭০ টাকা মজুরি থেকে বিগত সরকারের গেজেট অনুযায়ী ১৭৮.৫০ টাকা নির্ধারণ করে বিজ্ঞপ্তি দেয় চা বাগানের মালিকেরা। এরপর থেকে চা শ্রমিকের আন্দোলন তীব্র হয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, চা শ্রমিকের মজুরি নিয়ে আর প্রহসন না করে যৌক্তিকভাবে বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যথাযথ মজুরি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক।