মনোয়ার পারভেজ
আমরা স্বপ্ন দেখি সৃজনশীল বাংলাদেশের, তবে সৃজনশীল সৃজনশীল বলে সারা দুনিয়া স্লোগান তুলে জানিয়ে দিলেও অথবা সারাদিন গলা ফাটলেও সত্যি বলতে আমাদের কোনো কাজ হবে না, যদি না আমরা সঠিক ভাবে সৃজনশীলতার চর্চা করতে পারি; যদি না আমার নিজের সুপ্ত প্রতিভা থেকে কিছু প্রকাশ করতে পারি।
আমাদের সৃজনশীল উদ্ভাবনার মাধ্যমে বিশ্বের কাছে জানান দিতে হবে যে, আমরা সৃজনশীল। তখনই না আমরা সৃজনশীল জাতি। সৃজনশীল মানেই তো নিজ থেকে কিছু সৃষ্টি করা। নিজের ভিতরের প্রতিভাকে বাহিরে প্রকাশ করা। সুতরাং একজন কৃষকও সৃজনশীল হতে পারেন নতুন কোনো বীজ ধানের উদ্ভাবন সৃষ্টি করে।
সৃষ্টিশীল লেখক আহমদ ছফা মনে করতেন, 'যে জাতি উন্নত বিজ্ঞান, দর্শন এবং সংস্কৃতির স্রষ্টা হতে পারে না অথবা সেগুলোকে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না, তাকে দিয়ে উন্নত রাষ্ট্র সৃষ্টিও সম্ভব নয়।' সুতরাং সৃজনশীলতায় আমাদের স্রষ্টা হতে হবে। এই যে দেখুন না- সৃজনশীলতার দিক দিয়ে চীন, জাপান আমাদের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে রয়েছে।
সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে পরিক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটায়। তবে দেশে এখনো সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থায় পুরোপুরি সফল হতে পারে নি। কেমন করে হবে? দ্বিতীয় শ্রেনীতে পড়ুয়া আমার ভাগ্নেকে সেদিন দেখলাম গরুর রচনা মুখস্ত করছে। যে দেশের শিক্ষার্থীদের গরুর রচনা অথবা যেকোনো রচনাই মুখস্ত করতে হয় সেখানে সৃজনশীলতা আশা করা যায় কিভাবে?
রচনা শব্দের অর্থ বিন্যাস অথবা সাজানো। নিজের বুদ্ধিমত্তা থেকে সাজিয়ে ফুটিয়ে তোলার অর্থই রচনা। একসময় ইংরেজি রচনা মুখস্ত করাটা মানা যায়। কেননা আমরা জাতি হিসাবে বাঙালি, ইংরেজিতে যতই দক্ষ হই না কেন ব্রিটিশদের মতো ইংরেজি বাক্য তৈরি করা আমাদের সম্ভব নয়। কিন্তু বাঙালি হিসাবে বাংলা বাক্য তৈরি করতে না পারাটা আমাদের জন্য লজ্জার।
প্রশ্ন উঠবে, তাহলে আমরা কিসের বাঙ্গালী? মনের ভাব প্রকাশ করাই ভাষা। আর রচনায় মনের ভাব প্রকাশ করার কথাই বলা হচ্ছে। গনশিক্ষার প্রচার অভিযান নামক একটি সংস্থার তথ্যমতে, দেশের শতকরা ৩৭ জন শিক্ষক শিক্ষা দানের জন্য গাইড বইয়ের উপর নির্ভরশীল। একইভাবে তারা সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে অক্ষম। সুতরাং শিক্ষকরা যেখানে এখনো সৃজনশীল শিক্ষার কৌশল বুঝে উঠতে পারেননি, সেখানে শিক্ষার্থীরা কিভাবে বুঝে উঠবে?
এজন্য অবশ্য এককভাবে শিক্ষকদের দায়ী করা ঠিক হবে না। কেননা আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বছর বছরে পরিবর্তন আসে। শিক্ষা ব্যবস্থাই এখনো স্থির হতে পারেনি। এই পরিবর্তনের কারণে শিক্ষকদের শিক্ষার দানের সঠিক পদ্ধতি বুঝে উঠতে দ্বিধাগ্রস্ত হতে হচ্ছে। সুতরাং বলা যায়, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যতদিন না স্থির হবে ততদিন দেশের শিক্ষায় শতভাগ সফলতা আশা করা যাবে না।
শৈশবে আমাকেও মুখস্তবিদ্যা পড়ে আসতে হয়েছে। তবে আমি সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থাকেই বেশি উপযোগী মনে করি। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের দেশকে সৃজনশীল হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। একটা সৃজনশীল দেশ কতটা উন্নত সেটা আপনি চীন, জাপানের মতো সৃজনশীল উন্নত দেশের দিকে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন। তাদের দেশের শিক্ষার্থীরাই কয়দিন পরপর এটা ওটা আবিষ্কার করে ফেলছে। বিপরীতে এই বয়সে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা বিশ্বে কে কী আবিস্কার করে গেছেন সেগুলো মুখস্ত করছে !
আমরা শুধু মুখেই সৃজনশীল বলি। অথচ আমরা দৌড়াদৌড়ি করি মুখস্ত বিদ্যা ও পরীক্ষার মাধ্যমে অসুস্থ প্রতিযোগিতায়! আমাদের দেশের শিশুদের উপর নির্যাতনের বড় অংশ হচ্ছে শিশু বড় হয়ে কী হবে বা কী করবে তা নির্ধারণ করেন শিশুর অভিভাবক। দেশের অধিকাংশ অভিভাবকদের প্রথম ধারণাই হচ্ছে আমাদের সন্তান ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে। অথচ শিশুটা হয়তো-বা চেয়েছিল একজন খেলোয়াড়, সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক অথবা একজন আদর্শ শিক্ষক হতে। সেখানে আমাদের অভিভাবকদের কাছে সেই শিশুদের মতামত, ইচ্ছের কোনো মূল্যায়ন নেই! অভিভাবক তাদের নিজেদের দেওয়া মতামতের উপর ভিত্তি করে চাপ সৃষ্টি করেন তাদের সন্তানের উপর। অথচ খেয়াল করেন না সন্তানের ঐদিকে মনোযোগ আছে কি না। আমাদের সন্তানদেরকে নিজে থেকে স্বপ্ন দেখা শেখাতে হবে। তাহলে তার শিক্ষার আলোর অগ্রযাত্রা হবে পাকাপোক্ত।
এখন কথা হচ্ছে, দেশের অনেক অভিভাবক মনে করেন শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃজনশীলতা নাকি শিক্ষার্থীদের ধ্বংস করছে অথবা এই মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। আমি তাদের কথাকে একেবারেই ফেলে দিতে চাই না। আমাদের দেশে সৃজনশীল শিক্ষা কার্যক্রম এখনো পুরোপুরি সফল নয়। সৃজনশীল শিক্ষা পুরোপুরি কর্যকর করতে আমরা ব্যর্থ। দেশের ৩৭ ভাগ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না, সৃজনশীল প্রশ্ন বুঝেন না। যারা পারেন বা বুঝেন তারাও মোটামোটি ধরণের। এই মোটামোটি শব্দটাকে পুরোপুরি করতে হবে। কেননা অনেক শিক্ষক সৃজনশীল পাঠদান করতেও সফল নন বা অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারেননি। ফলে শিক্ষার্থীরাও সৃজনশীলতা বুঝে উঠতে পারছে না।
তাই বলে সৃজনশীল শিক্ষাকে ভুইফোঁড় বলা ঠিক হবে না। কেননা উন্নত জাতি গঠনে সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থার বিকল্প নেই। সুতরাং আমাদের সৃজনশীল হতে আরও দক্ষ হতে হবে, এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রধান সম্পাদক: জাকেরিন চৌধুরী জয়
অফিস: ১০৪/১১ নূরানী বনকলাপাড়া,
সুবিদ বাজার সিলেট।
মোবাইল : ০১৬০১০৩৮৪৮১, Email: thewallnews181@gmail.com