• ১৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৩০শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৩ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

নবীনদের প্রতি স্বকীয় ভাবনা

The Wall News.Com
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৪
নবীনদের প্রতি স্বকীয় ভাবনা

তাওহীদুর রহমান শাহ্‌

‘আউট অব দ্য বক্স’ মানে হল বৃত্তের বাইরে। ‘আউট অব দ্য বক্স থিংকার’ মানে হচ্ছে বৃত্তের বাইরের ভাবুক। পক্ষান্তরে যারা একই বৃত্তে আবর্তিত হয়ে আসছে আজন্ম- বাংলা অভিধান তাদের প্রকাশ করতে ‘কূপমণ্ডূক’ শব্দটি ব্যবহার করে যার অর্থ সংকীর্ণমনা। কূপমণ্ডূকরা কী করে, কুয়া থেকে তারা যে আকাশ দেখে তা একটি গোল চাকতি; অথচ সীমাহীন আকাশের পরিসর সম্পর্কে তারা আমৃত্যু অজ্ঞই থেকে যায়।

দুটি দ্বান্ধিক বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ধরা যাক- বৃত্তের বাইরে কারা ভাবে আর কেনো’ই-বা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ একই বৃত্তে নিয়ত ঘোরপাক খায়? যারা বাইরের জগৎ সম্পর্কে চোখ-কান খোলা রেখে চলনসই জ্ঞান রাখে তারা বৃত্তের বাইরের ভাবুক। আর যারা মান্ধাতা আমলের প্রাণিকূলের মত জন্ম নেওয়া, উদরপূর্তি, বিয়ে, বাচ্চা উৎপাদন এবং পরিশেষে মারা যাওয়াকে জীবন বলে ধরে নেয় তারা বৃত্তের অন্তর্গত।

বৃত্তের বাইরে ভাবতে হলে একজনকে প্রথমেই নিজেকে চিনতে হবে। গতানুগতিক পারিপার্শ্বিকতা থেকে বেরিয়ে আত্মোন্নতিকল্পে যদি না আলাদা কিছু করা হয় তবে কিন্তু শৃঙ্খলিত অবস্থাই চিরাচরিত – একথা মেনে নিতে হবে। পরিবার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ইত্যকার বেঁধে দেওয়া সংকীর্ণ পরিবেশে আমরা একগেয়ে হয়ে উঠলেই কেবল বাইরের জগৎ সম্পর্কে ধারণা রাখতে পারি। তাই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বেড়ে উঠলেও শৃঙ্খলিত হলে চলবে না, বেরিয়ে পড়তে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমাদের পাশ করিয়ে দিলেও জীবন গড়ে দেওয়া তো বহুদূর জীবনের সঠিক সংজ্ঞাটাও উপলব্ধি করানোকে কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করে নি কোনোকালেই। বলা বাহুল্য নয় যে, অন্তত উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত কেউ যদি জ্ঞানার্জনের জন্য পড়ত তবে সমাজের উল্লেখযোগ্য একটা অংশের বুদ্ধি আড়ষ্ঠ হত না। কিন্তু আমরা পাশ করাকেই মুখ্য ভেবেছি যা ভাবিয়েছে আমাদের চলমান শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তদসংশ্লিষ্ট মহৎ ব্যক্তিরা। তাই বলে আমাদের থেমে থাকলে চলবে না।

জানা, বুঝা ও উপলব্ধির মাধ্যমেই একজনের দ্বারা যেকোন কল্যাণধর্মী কাজ করা সম্ভব। আমার পরিচিত এক অনুজ যে জনৈক ছাত্র সংগঠনের কর্মী তার কাছে একদিন জানতে চেয়েছিলাম তার সমর্থিত সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতার নাম ও প্রতিষ্ঠাকাল কবে? কি মনে হয়, সে পেরেছিল উত্তর দিতে? পারে নি। এই ব্যর্থতাটুকু তার নয়, তার সমর্থিত সংগঠনের। কেননা ঐ সংগঠনে এগুলোর চর্চা নেই। শুধু ঐ সংগঠনেই নয় বাংলাদেশে পালাক্রমে যেসন রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়েছে প্রত্যেক দলের ছাত্র সংগঠনের সাংগঠনিক কাঠামোতে জ্ঞানচর্চার কোন সুযোগ বা বাধ্যবাধকতা নেই। অথচ একজন রাজনৈতিক কর্মীর কেবল তার সমর্থিত দল সম্পর্কেই নয় অন্তত নিজ দেশে প্রকাশমান সবকয়টি রাজনৈতিক দলের উত্থানের ইতিহাস ও দলগুলোর লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখা জরুরী বৈ কি।

একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন স্কাউটিংয়ের সাথে একযুগেরও অধিক সময় জুড়ে লেগে আছি। বিশ্বব্যাপী গতিশীল স্কাউটিং আন্দোলনের মূলনীতি হচ্ছে,
১। স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য পালন
২। নিজের প্রতি কর্তব্য পালন
৩। অপরের প্রতি কর্তব্য পালন

সমাজকে, দেশকে কিছু দিতে হলে সর্বাগ্রে নিজেকে তৈরি করতে হবে সৎ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে। এই অবশ্য পালনীয় কর্তব্যগুলো ব্যাক্তি হিসেবে সবারই পালন করা দরকার।

জানা, বুঝা ও উপলব্ধি- ফিরে যাই মূলকথায়। জানার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হল বই। আমরা তাবৎ পৃথিবী সম্পর্কে যা কিছুই জেনেছি তার একটা বৃহৎ অংশই কোনো না কোনোভাবে পুঁথিগত বিদ্যার অন্তর্গত। ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, ধর্মজ্ঞান, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়াবলীতে চলনসই জ্ঞান অর্জন তাই মানুষ হিসেবে অবশ্য পালনীয় কাজ। আমরা যখন কার্যত জ্ঞান অর্জনে ব্রতী হব তখনই এক নতুন আমি’কে আবিষ্কার করব। এহেন কার্যসিদ্ধিতে তাই বই পড়ার বিকল্প নাই।

আমি অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি কিছু বই পড়ার পর প্রকৃতির চিরচেনা উপাদান ঘাস লতাপাতা গুল্ম বৃক্ষ সবজিরমাঁচা হাঁস গরু কাদা জল কেমন নিজ নিজ মনে হয়। গরীব, খেটে খাওয়া মানুষকে কেমন জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে- তাঁদের বুকের ভেতরকার হৃদযন্ত্রের স্পন্দন মাপতে মন চায় , করমর্দনের ছলে দেখতে ইচ্ছে করে তাঁদের হাতের তালু কতটা শক্ত।

নামকরা কলেজ থেকে উল্লেখযোগ্য ফলাফল নিয়ে স্নাতক পাশ করেও কেউ ততটা আনন্দিত হয়না যতটা পুলকিত হয় দেশ-বিদেশের কালজয়ী সাহিত্যের অল্পবিস্তর পুস্তক অধ্যয়নে। বস্তুত, জানার এই আকাঙ্ক্ষা ও বুঝার এই পারঙ্গমতার মূলেই কিন্তু প্রগাঢ় উপলব্ধি। সর্বোপরি নিজেকে গড়তে হলে মনের আনন্দের খোরাক বইপড়ার গুরুত্ব অপরিসীম।

আমাদের যেহেতু সমাজের মানুষের সাথে কাজ করতে হবে সেহেতু সমাজের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অটুট রাখার মাধ্যমেই জনহিতকর কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। আমার সামনে অবস্থানরত একেকটি ফুল যেন সুঘ্রাণসমেত বাগানের শোভাবৃদ্ধিতেই নয় বরং ছড়িয়ে পড়ুক গ্রামের প্রতিটি আলপথে, কোমল মৃত্তিকায় আত্মিক স্পর্শে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাজ্ঞজন, সৃষ্টিশীল লেখক আহমদ ছফা’র উক্তি দিয়েই শেষ করছি- “ বিপ্লব মানে ভাঙা নয়, পুণর্গঠন।’’