ওয়াল নিউজ ডেস্ক
ভারতকে শান্তিপ্রিয় দেশ উল্লেখ করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং দেশটির সশস্ত্র বাহিনীকে ভবিষ্যৎ যুদ্ধ মোকাবিলার জন্য তৈরি থাকতে বলেছেন। গত বৃহস্পতিবার উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌতে সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডারদের প্রথম যৌথ সম্মেলনে তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের পাশাপাশি বাংলাদেশের পরিস্থিতির উল্লেখ করে এ কথা বলেন। তিনি জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের এসব ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণেরও পরামর্শ দেন।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে রাজনাথ সিংয়ের এ বক্তব্য তুলে ধরা হয়। গত বৃহস্পতিবার বিবৃতিটি ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (পিআইবি) প্রকাশ করেছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এমন মন্তব্য করা অনুচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা।
কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির ঘটনা ভারতকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। দেশটির বিজেপি নেতৃত্ব শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সমর্থনের কথা প্রকাশ্যে বলেছে। ফলে বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি তাদের বিচলিত করেছে।
যে প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন, তা উদ্বেগের এবং সেটা সমীচীন নয়।
ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ দূর করার বিষয়ে গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে ভারত সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছে। এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে থেকে নিরাপত্তার বিষয়ে ভারত সেই সহযোগিতা পেতে চায়। তবে এটা ঠিক যে নিকট প্রতিবেশী বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা ইসরায়েল-হামাসকে এক করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
ভারতের শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বের ওই সম্মেলনের দ্বিতীয় ও শেষ দিন ছিল বৃহস্পতিবার। সম্মেলনে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরায়েল-হামাস সংঘাত এবং বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে তাঁর দেশের সামরিক কমান্ডারদের এসব ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করার পরামর্শ দেন। এই প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতে ভারত যেসব সমস্যার মুখে পড়তে পারে, তা বিবেচনায় সামরিক বাহিনীকে ‘অপ্রত্যাশিত’ ঘটনা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। ভারতের উত্তর সীমান্তের পরিস্থিতিসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বের মাধ্যমে বিস্তৃত ও গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, এসব বিষয় এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। রাজনাথ সিং তাঁর বক্তব্যে যৌথ সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকশিত করা এবং উসকানির ক্ষেত্রে সমন্বিত, দ্রুত ও আনুপাতিক প্রতিক্রিয়ার ওপরও জোর দেন।
ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সম্মাননীয় ফেলো সি রাজা মোহন দিল্লি থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে তিনি মনে করেন না।
তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ূন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিকট প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের কাছ থেকে আমরা সংবেদনশীলতা প্রত্যাশা করি। এমন কোনো মন্তব্য ও বক্তব্য ভারতের নেতৃত্বের কাছ থেকে আসা সমীচীন নয়, যেটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দিল্লি চলে যাওয়ার পর থেকে একধরনের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক। ভারত এ পরিবর্তন এখনো স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি বলে মনে করেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
৮ আগস্ট বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শুভকামনা জানিয়ে এক্সে পোস্ট দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এরপর গত ১৭ আগস্ট ড. ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ফোনালাপ হয়। তাঁদের ফোনালাপে বাংলাদেশে হিন্দুদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিও আসে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ফোনালাপেও এসেছে। ২৬ আগস্ট এ ফোনালাপে বাংলাদেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা এবং সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের নিরাপত্তার প্রসঙ্গে দুই শীর্ষ নেতার আলোচনা হয়েছে বলে ভারতের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে।
১ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশের কিশোরী স্বর্ণা দাস নিহত হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানায়। সর্বশেষ ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআইয়ে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত এনে বিচার করা, তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান, সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন। এরই মধ্যে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মন্তব্য করলেন।
নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান মনে করেন, যে প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন, তা উদ্বেগের এবং সেটা সমীচীন নয়।
এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আর ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করেছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ। তাই এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। রাজনাথের এই উক্তির অন্তর্নিহিত কারণ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। প্রয়োজনে কূটনৈতিক পরিসরে প্রশ্ন করেও আমাদের এটা জানা জরুরি।’
প্রধান সম্পাদক: জাকেরিন চৌধুরী জয়
অফিস: ১০৪/১১ নূরানী বনকলাপাড়া,
সুবিদ বাজার সিলেট।
মোবাইল : ০১৬০১০৩৮৪৮১, Email: thewallnews181@gmail.com